Header Ads Widget

মুন্সীগঞ্জের শিপইয়ার্ড থেকে জাহাজ 'উধাও' হলো কীভাবে ?



 বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জের একটি শিপইয়ার্ড থেকে মেরামতের জন্য রাখা একটি তেলবাহী জাহাজ উধাও হয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগে শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ এবং জাহাজটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান উভয়েই থানায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দিয়েছে।

জাহাজটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ তাদের জাহাজটি কেটে ফেলেছে। এটি কাটার ভিডিও ফুটেজ এবং প্রমাণ রয়েছে বলে দাবি তাদের। তবে, তদন্তের স্বার্থে এসব ভিডিও গণমাধ্যমকে দেয়া হচ্ছে না বলেও জানানো হয়।

এদিকে, শিপইয়ার্ডের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের দাবি, যারা জাহাজটি মেরামত করতে দিয়ে গিয়েছিল, তারাই জাহাজটি তাদের অগোচরে নিয়ে গেছে।

প্রশ্ন উঠেছে শিপইয়ার্ড থেকে একটি বিশাল আকারের জাহাজ কিভাবে উধাও হতে পারে?

যা বলছে শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ

মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার নয়ানগরে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেডের শিপইয়ার্ড অবস্থিত। ২০২৩ সালের ২৩শে মে এই শিপইয়ার্ডে বেঙ্গল ইলেকট্রিক লিমিটেডের মালিকানাধীন টি. টেকনাফ নামে একটি তেলবাহী ট্যাংকার জাহাজ মেরামতের জন্য দেয়া হয়। তিন ব্যক্তি এই জাহাজ মেরামতের জন্য প্রতিষ্ঠানটির কাছে নিয়ে আসে।

থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড প্রতিষ্ঠানটি মূলত জাহাজের ডিজাইন তৈরি এবং মেরামত করে থাকে।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, জাহাজটি আনার পরে অল্প কিছু মেরামত করা হয়। বিশাল এ জাহাজটির মেরামতের বাকি কাজ করতে দুটো এয়ারব্যাগের মাধ্যমে জাহাজটিকে স্লিপওয়েতে (যেখানে জাহাজ মেরামত করা হয় ) ওঠানোর চেষ্টা করা হয়।

কিন্তু বিশাল জাহাজটি ওঠাতে গিয়ে এয়ারব্যাগগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরো জাহাজটি সেখানে ওঠানো যায় নি। এয়ার ব্যাগগুলোর আনুমানিক দাম ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকা বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

পরে আর বাকি কাজ করতে না পেরে অপারগতা প্রকাশ করা হয় প্রতিষ্ঠানটির কাছে। সাধারণত মেরামতের কাজ শেষ হতে এক থেকে দেড় মাসের বেশি সময় লাগে না। কয়েক মাস পরে বিল পাঠানো হয়।

কিন্তু দিচ্ছি, দিবো বলে টাকা পরিশোধ না করে ওই ব্যক্তিরা টালবাহানা করতে থাকে বলে দাবি শিপইয়ার্ড প্রতিষ্ঠানের। এরপর আবারো বিল পাঠানো হয়। জাহাজটির মেরামত এবং নোঙর খরচ বাবদ প্রায় ৩০ লাখ টাকা বিল হয়।

কিন্তু কেউ যোগাযোগ করে নি বলে দাবি করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের।

নভেম্বর -ডিসেম্বর মাসে যখন মেঘনা নদীর পানি যখন কম ছিল তখন জাহাজটি পানির ওপরে ডাঙায় ছিল।

শিপইয়ার্ড প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ, এরপরে মার্চ -এপ্রিল মাসের দিকে নদীর পানি যখন জোয়ারে বৃদ্ধি পায় তখন দুইবার জাহাজটি নিয়ে যেতে টাগবোট নিয়ে এসেছিল ওই ব্যক্তিরা। কারণ তখন জাহাজটি পানিতে ভাসছিল।

শিপইয়ার্ড প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক (অপারেশন) মো. মোজাম্মেল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ জাহাজটি পানিতে নামিয়ে দেয়ার পরে তারা বিল না দিয়ে দুইবার জাহাজটা নেয়ার জন্য টাগবোট নিয়ে আসে। ওই জাহাজে তাদের তিনজন পাহারাদার ছিল। বলছে বিল দেবে”।

“কিন্তু পানিতে নামিয়ে দেয়ার পর আর বিল দেয় নি। কিন্তু বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে জাহাজ দিয়ে দেয়ার জন্য হুমকি দেয়। আমরা বিল দিয়ে জাহাজ নিতে বলি ”।

এর মধ্যে গত ১৮ই মে রাতে তারা জাহাজটি সরিয়ে ফেলেছে বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা।

গত ২৯শে গজারিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

এই জিডিতে অভিযোগ করা হয়েছে, মিলন হাজী, আলাউদ্দিন ও রফিক এবং অজ্ঞাত আরো চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে জাহাজটি শিপইয়ার্ডে নোঙর থাকায় প্রায় তিশ লাখ টাকা বিল আসে। কিন্তু আসামিরা দিচ্ছি, দিবো বলে ঘুরাতে থাকে এবং জাহাজটি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে আসছিল।

বিল না দিয়ে বরং আসামিরা উল্টো হুমকি দিচ্ছিল বলে এই জিডিতে অভিযোগ করে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড।

১৮ই মে রাত আনুমানিক একটা থেকে ভোর পাঁচটার মধ্যে শিপইয়ার্ড সংলগ্ন মেঘনা নদী থেকে জাহাজটি তাদের অগোচরে আসামিরা নিয়ে যায় বলে জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

মি. হক বলেন, “ ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা ও করবো ”।

যা বলছে জাহাজটির কর্তৃপক্ষ

টি. টেকনাফ জাহাজটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৮০ ফিট এবং প্রস্থে ৩০ ফিট চওড়া।

শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ জিডি করার পরদিনই পাল্টা আরেকটি জিডি করে জাহাজটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান দ্যা বেঙ্গল ইলেকট্রিক লিমিটেড।

এই জিডিতে বলা হয়, গতবছরের ২৩শে মে মো. আবুল রশিদ এবং মো. মিজানুর রহমান ওই তেলবাহী ট্যাঙ্কার জাহাজটি মেরামতের জন্য নয়া-নগরের থ্রি এঙ্গেল মেরিন শিপইয়ার্ডে নিয়ে যায়। সেখানে নেয়ার পর ওই কর্তৃপক্ষ মেরামতের জন্য জাহাজটি তাদের শিপইয়ার্ডে উঠায়।

এরপর মেরামত করে ২০২৩ সালের ১৯শে অক্টোবর এবং এ বছরের ৩রা জানুয়ারি মেরামতের বিল পাঠানো হয়।

বিল পাওয়ার পর পরিশোধ করতে ও জাহাজটি নিয়ে আসার জন্য ২৯শে মে এই প্রতিষ্ঠানের দুইজন ব্যবস্থাপক সঞ্জয় কুমার সাহা এবং খালেকুজ্জামান রায়হান থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেডের শিপইয়ার্ডে যান।

সেখানে জাহাজটি না পেয়ে শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানতে পারেন জাহাজটি শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছে বলে জিডিতে অভিযোগ করা হয়েছে।

একইসাথে শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষকে জাহাজটি কোথায় প্রশ্ন করলে তারা কোন সদুত্তর দিতে পারে নি বলে এতে অভিযোগ করা হয়েছে। একইসাথে জাহাজটি খোঁজ করতে থাকলে তাদের হুমকি দিয়ে শিপইয়ার্ড থেকে বের করে দেয়া হয়।

এই জিডিতে শিপইয়ার্ড প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল ইসলামসহ সাতজনকে বিবাদী করা হয়েছে।

শিপইয়ার্ড প্রতিষ্ঠানটি জাহাজটি সরিয়ে ফেলেছে উল্লেখ করে জিডিতে বলা হয়েছে, এর আনুমানিক দাম প্রায় সাত কোটি টাকা।

জাহাজটি খুঁজতে ব্যস্ত থাকায় জিডি করতে দেরি হয়েছে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ একটা ভুতুড়ে বিল করে। ঈদুল ফিতরের পর সেটি সংশোধন করে দেয়ার কথা ছিল।

কিন্তু ঈদের পরে বিল সংশোধন ও জাহাজটির অবস্থা দেখতে গেলে জাহাজের কর্তৃপক্ষকে বের করে দেয়া হয় শিপইয়ার্ড থেকে। শিপইয়ার্ডের কর্মকর্তারা তাদের জানায়, জাহাজটি কোন একটি চক্র নিয়ে গেছে।

দ্যা বেঙ্গল ইলেকট্রিক লিমিটেডের উপ- ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোত্তাকিন সালাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ জাহাজ স্লিপওয়ে থেকে অন্য কেউ নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। কারণ স্লিপওয়ে রেললাইনের মতো। জাহাজটার ইঞ্জিন বিকল আর নিতে হলে টাগবোট প্রয়োজন। রেললাইন থেকে টেনে নিয়ে আসতে পারবে না। এটা কোনদিন সম্ভব না”।

মি. সালাম দাবি করেন শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ জাহাজটি কেটে ফেলেছে।

এ ধরণের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল বলে দাবি করেন তিনি।

কারণ আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ি বিল পরিশোধ না করলে উকিল নোটিশ পাঠাতে হয়। পরপর তিনবার পর্যন্ত না দিলে আদালতের মাধ্যমে জাহাজটির অকশন করে বিক্রির আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে।

মি. সালাম বলেন, “ গত চার -পাঁচদিন আগে জাহাজটা কিভাবে কাটতেছে, ওনাদের ডকইয়ার্ডের ক্রেন, ওনাদের ডকইয়ার্ডের ইকুইপমেন্ট, লোকজন সব জড়িত এমন ভিডিও এবং এভিডেন্স পেয়েছি। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে এটা কাউকে দেইনি”।

“আমরা অলরেডি নিশ্চিত এবং আমরা শনাক্ত করেছি এটা থ্রি এঙ্গেল মেরিন ডকই কেটেছে এবং ওনারা পুরা জাহাজটার টাকাটা আত্মসাৎ করেছে” বলে দাবি করেন মি. সালাম।

গজারিয়া থানার ওসি রাজীব খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, তারা দুই পক্ষের কাছ থেকেই অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করেছেন।

‘’আমরা অভিযোগ পেয়েছি, এখন তদন্ত চলছে। তবে এখনো যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে,‘’ তিনি বলেন।

THE BUSINESS WORLD 

Post a Comment

0 Comments